খোশখবর ডেস্কঃ ১৮৫০ সাল থেকে চেষ্টা করে বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ আইনটি চালু করাতে পেরেছিলেন ১৮৫৬ সালে। ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৭ এই ১২ বছরে বিদ্যাসাগর নিজেই ৬০ জন বিধবার বিয়ে দেন এবং এর জন্যে খরচ হয়েছিল তখনকার দিনে ৮২ হাজার টাকা।এত কান্ডের পরেও একটি বিধবাবিবাহের ক্ষেত্রে আত্মীয়দের সংগে বিদ্যাসাগরের মনোমালিন্য হয়। পাত্র কেচকাপুর স্কুলের প্রধান পন্ডিত শ্রীযুক্ত মুচিরাম বন্দোপাধ্যায়, বাড়ি ক্ষীরপাই। পাত্রী শ্রী কাশীনাথ পালধির কন্যা শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী। বাড়ি কাশীগঞ্জ।একসময় ক্ষীরপাহী নিবাসী হালদার বাবুরা ছিলেন বিধবা বিবাহ বিরোধী। উক্ত বিবাহের সংবাদ অবগত হয়ে হালদার বাবু বিদ্যাসাগরের কাছে সকাতরে প্রার্থনা জানান মুচিরামের এই বিবাহ যেন না হয়। বিদ্যাসাগর হালদার বাবুর প্রার্থনা পূরন করতে রাজি হন। অগত্যা মনোমোহিনীকে বিদ্যাসাগরের বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হয়। তিনি কাছেই সনাতন বিশ্বাসের বাড়ি আশ্রয় নেন। সেখানে মনোমোহিনী কে নিয়ে যান বিদ্যাসাগরের আত্মীয় ভ্রাতা দীনবন্ধু ন্যায়রত্নের পুত্র গোপাল চন্দ্র, রাধানগরের কৈলাশ চন্দ্র মিশ্র এবং বিদ্যাসাগরের আর এক ভাই ঈশান চন্দ্রের পরামর্শে। শম্ভুচন্দ্র( শম্ভুচন্দ্র, দীনবন্ধু, ঈশানচন্দ্র তিন ভাই) আর রাধানগরের চোধুরীবাবুদের নায়েব উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের কাছে বসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের ইচ্ছায় শম্ভুচন্দ্র লোক পাঠিয়ে সনাতন বিশ্বাসকে ডেকে পাঠালেন। সনাতন বিশ্বাস তাঁর বাড়ি থেকে মনোমোহিনীকে বের করে দিতে রাজি হলেন না। উমেশচন্দ্র সনাতনকে বললেন, তোমরা এর মাসোহারা খাও, এর একটা কথা শুনলে না? সনাতন বিশ্বাস উত্তর দিলেন, আমরা পুরুষানুক্রমে কৈলাশ মিশ্রের বাড়িতে চাকরি করে আসছি। তিনি নিজে আমাকে এই মাত্র বললেন, ‘তুমি মেয়েটিকে তোমার বাড়িতে রাখো, কারো কথায় বের করে দিও না। আমি কাল সন্ধ্যার আগে এসে এই বিধবার বিবাহ দেব। আমি কোনমতে তাঁর কথার অবাধ্য হতে পারব না। বরং যে ক’টাকা মাসোহারা দিয়েছেন তা ফেরৎ দিতে রাজি আছি।’গোপালচন্দ্র এবং ঈশানচন্দ্র চাঁদা করে এই বিবাহের আয়োজন করলেন। বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেল। ১২৭৬ সালের আশ্বিনে ‘বামাবোধিনী পত্রিকা লিখছে, সম্প্রতি জাহানাবাদের একটি বিধবা বিবাহ হইয়াছে। বর কোচকাপুর হাই স্কুলের প্রধান পন্ডিত শ্রীযুক্ত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, নিবাস ক্ষীরপাই। পাত্রী কাশীগঞ্জ নিবাসী শ্রী কাশীনাথ পালাধির কন্যা শ্রীমতী মনোমোহিনী দেবী। পরবর্তীকালে ভ্রাতা শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন বিদ্যাসাগরের নামে অভিযোগ করেন, “মুচিরামের বিবাহের সময় উক্ত বিবাহ ন্যায্য এবং শাস্ত্র সম্মত স্বীকার করিয়াও বিধবাবিবাহ বিদ্বেষী ক্ষীরপাই নিবাসী হালদার বাবুদের অনুরোধে (বিদ্যাসাগর) পশ্চাৎপদতার ও কাপুরুষতার পরিচয় দিয়া ক্ষান্ত হয়েন নাই বরং ঐ সময়ে তিনি ঐ বিবাহের প্রতি যারপরনাই বিদ্বেষভাব পোষন করিয়াছেন”।বিবাহের পরদিন সকালে বিদ্যাসাগর ঈশানচন্দ্রকে বললেন, ঈশান কেন তুমি বিবাহ দেওয়ালে, এতে আমার বড় অপমান হয়েছে।ঈশান বললেন, কৈলাশ মিশ্র ও আমি গত পরশু আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, এই বিধবাবিবাহ ন্যায্য কিনা? আপনি উত্তর দিয়েছেন, এ শাস্ত্র সম্মত স্বীকার করি, কিন্তু হালদারবাবুদের মনে দুঃখ হবে। লোকের খাতিরে এই সকল বিষয়ে ক্ষান্ত হওয়া আপনার মত মানুষের পক্ষে দোষের কথা।বিদ্যাসাগর রাগ করে বললেন, তুই কি এখনো সেইরূপ দুর্মুখ আছিস এবং এইরূপই কি চিরকাল থাকবি?এরপরই বিদ্যাসাগর চিরদিনের জন্য বীরসিংহ ত্যাগ করলেন।কলকাতায় আসার সময় ভাইদের আর সম্ভ্রান্ত গ্রামবাসীদের বললেন, ‘তোমরা আমাকে দেশত্যাগী করালে’।এরপর জীবনে আর কোনদিন বীরসিংহ যাননি। জীবন শেষ করেছেন কর্মাটারে।অনেক ভাল কাজ করার পরেও হালদার বাবুদের কথায় কেন যে মুচিরামের বিয়েটা ভেঙে দিতে যাচ্ছিলেন তার কোন যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। শম্ভুচন্দ্র, দীনবন্ধু, ঈশানচন্দ্র গোপাল চন্দ্র, কৈলাশ মিশ্র, সনাতন বিশ্বাসরা তাঁর এই কাজ মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা এই বিবাহ সুসম্পন্ন করেছেন আর তাতেই তাঁর মর্যাদায় ঘা লেগেছে। অভিমানে সারা জীবনের জন্য তিনি দেশছাড়া হয়েছেন।
সূত্র - অভিমানী বিদ্যাসাগর,অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়,গল্পের সময় ডট কম
সোশ্যাল মিডিয়ায় 'খোশখবর'